কানের অসুখ প্রধানত উপসর্গ ভিত্তিক। কানে ব্যথা, কানে তালা, কানে শব্দ, কানের পুঁজ, কান চুলকানি বা মাথা ঘোরা। সব থেকে বেশি যে উপসর্গ রোগী এবং ডাক্তার— দুই পক্ষকেই ভাবিয়ে তোলে তা হল কান দিয়ে বারে বারে জল বা পুঁজ গড়ানো।

জল বা পুঁজ কেন পড়ে: কানের তিনটে ভাগ। বহিঃকর্ণ, মধ্যকর্ণ ও অন্তঃকর্ণ। কানের ফুটো থেকে পর্দা পর্যন্ত বহিঃকর্ণ, পর্দার ওপারে মধ্যকর্ণ। এদের প্রদাহ বা ইনফেকশন হলে কান দিয়ে জল বা পুঁজ গড়াতে পারে।

  • বহিঃকর্ণের প্রদাহের মধ্যে আছে কানে ফোঁড়া, ছত্রাকের আক্রমণ, কানে খোল, কানে কোনও কিছু ঢুকে থাকলে তার থেকে প্রদাহ, একজিমা, অ্যালার্জি ইত্যাদি।
  • মধ্যকর্ণের প্রদাহের মধ্যে পড়ে স্বল্পমেয়াদি প্রদাহ বা অ্যাকিউট ওটাইটিস মিডিয়া ও দীর্ঘমেয়াদি প্রদাহ বা ক্রনিক এটাইটিস মিডিয়া

এর পেছনে কারণ: কানের অসুখের নেপথ্যে নানা কারণ আছে।

  • হঠাৎ করে ঠান্ডা লেগে মধ্যকর্ণ ও নাকের পিছনের সংযোগনালী (ইউস্টেশিয়ান টিউব) বন্ধ হয়ে যাওয়া।
  • কানে নোংরা জমে বা শিশু বয়সে দুধ ঢুকে যাওয়া।
  • কানের কোনও গণ্ডগোল যেমন পলিপ, টিউমার, রাইনাইটিস, পার্টিশনের বাঁকা হাড়, সাইনাসাইটিস ইত্যাদি। গলার কোনও গণ্ডগোল যেমন, টনসিলাইটিস, ফ্যারিনজাইটিস।
  • বুকের নানা অসুখ যেমন ব্রঙ্কাইটিস, নিউমোনিয়াইটিস। দাঁতের নানা ধরনের ইনফেকশন। শক্ত খাবার, নোংরা পরিবেশে বসবাস, অ্যালার্জি ও নোংরা পুকুরে দীর্ঘকাল স্নান।
  • শিশুর ত্বক ও চুল অপরিষ্কার রাখা, নোংরা জামাকাপড় পরানো। কানের সামনে হঠাৎ করে কোনও প্রচণ্ড শব্দ হলেও পর্দা ফুটো হয়ে পরবর্তীকালে কান দিয়ে বারে বারে জল বা পুঁজ গড়াতে পারে। বিমান ভ্রমণের সময়ে হঠাৎ করে বায়ুমণ্ডলের চাপের তারতম্যের ফলেও এটা হতে পারে।
  • ইনফ্লুয়েঞ্জা সহ নানা ভাইরাসঘটিত রোগের ফলেও কানে সংক্রমণ হতে পারে।

রকমারি উপসর্গ: কানে জল পড়া হঠাৎ করেই শুরু হতে পারে। কান ব্যথা নিয়ে ব্যথার ওষুধ খেয়ে ঘুমোলেন, ভোরবেলায় উঠে দেখলেন কানের জলে বালিশ ভিজে রয়েছে। আবার কয়েকদিন ধরে হাঁচি-কাশি, নাক বন্ধ, কান ব্যথার পর কান থেকে জল ঝরতে পারে। প্রথম পর্যায়ে কান দিয়ে শুধু জলই ঝরে অর্থাৎ ওয়াটারি ডিসচার্জ। দিন কয়েক বাদে জীবাণু সংক্রমণের ফলে পুঁজ ঝরতে থাকে, যাকে বলে পুরুল্যান্ট ডিসচার্জ। কানে খোল হলে আঠালো চটচটে ক্ষরণ হতে পারে। কানে ফাংগাস হলে সাদা ভিজে ব্লটিং পেপারের গুঁড়ো বা কয়লার গুঁড়োর মতো বার হতে পারে। কানের পর্দায় ফুটো থাকলে বারে বারে মধ্যকর্ণের প্রদাহের ফলে পুঁজ পড়ে। অনেক সময় সেই পুঁজ পরিমাণে কম, কিন্তু দুর্গন্ধযুক্ত হয়। পর্দায় কোনখানে ফুটো হয়েছে (সেন্ট্রাল বা মার্জিনাল) তার উপর রোগের তীব্রতা নির্ভর করে। কান দিয়ে রক্তপাত হতে পারে ভাইরাসের সংক্রমণে, হঠাৎ চোট লাগলে, মাংসপিণ্ড বা গ্রানুলেশন হলে এবং অবশ্যই ক্যান্সার হলে। কাজেই কান থেকে নানা ধরনের ক্ষরণের পিছনে নানা রকম কারণ আছে। ক্ষরণের সঙ্গে অনেক সময় কানে অসহনীয় ব্যথা থাকে, কান ফুলে থাকে, কানে শুনতে কষ্ট হয় বা দীর্ঘস্থায়ী মধ্যকর্ণের প্রদাহের ক্ষেত্রে কোনও উপসর্গ ছাড়াই হঠাৎ করে কান দিয়ে রস বা ঘন পুঁজ ঝরতে পারে।

অবহেলা করলেই বিপদ: বারে বারে সংক্রমণ হলে কানের পর্দা তো ফুটো হয়ই, অনেক সময় পুরো নষ্টও হয়ে যায়। মধ্যকর্ণের হাড় ক্ষয়ে যায়, শ্রবণক্ষমতা কমতে থাকে, অন্তঃকর্ণেও রোগ ছড়িয়ে পড়ে। ফলে মাথা ঘোরা, মাথায় যন্ত্রণা, বমি, জ্বর, নানা উপসর্গ দেখা যায়। অসুখ ছড়িয়ে পড়তে পারে মস্তিষ্কের হাড় বা খুলির মধ্যে। নানা ধরনের অ্যাবসেস ও অস্টিওমায়িলাইটিস দেখা দিতে পারে। ফেসিয়াল নার্ভ প্যারালিসিস হয়ে ঠোঁট-মুখ বেঁকে যেতে পারে। এ ছাড়া মেনিনজাইটিস, এনকেফেলাইটিসের মতো ভয়ঙ্কর অসুখে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। কানে পুঁজ পড়ার সঙ্গে মাথা ঘোরে, বমি ভাব, কম শোনা ও মাথার যন্ত্রণা— এই চারটি উপসর্গ থাকলে তৎক্ষণাৎ ডাক্তারের পরামর্শ নেবেন।

সাবধানতা: কানের অসুখকে কখনও অবহেলা করবেন না। বিশেষ করে বারে বারে কান দিয়ে পুঁজ পড়া।

  • ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া কোনও কানের ড্রপ, ঘরে পড়ে থাকা কোনও পুরনো ড্রপ কখনও ব্যবহার করবেন না। কান নিয়মিত পরিষ্কার রাখবেন, বিশেষ করে কানে ড্রপ দেওয়ার ঠিক আগে বাড্‌ড্স দিয়ে কান পরিষ্কার করে নেবেন।
  • নাক, গলা, সাইনাস বা বুকের কোনও অসুখ থাকলে অবশ্যই চিকিৎসা করাবেন। বিশেষ করে পচা সেপটিক টনসিল যাঁদের আছে। প্রয়োজনে অপারেশন করে টনসিল বাদ দিতে হবে।
  • শিশুদের সব সময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখবেন। নোংরা পোশাক, স্যাঁতসেঁতে, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বাস, অপুষ্টি থেকে অন্য অসুখের সঙ্গে কানের অসুখও হয়।
  • ঠান্ডা লাগাবেন না। ফ্রিজের ঠান্ডা জল ও খাবার খাবেন না। কানে পালক, দেশলাইকাঠি বা কাগজ পাকিয়ে কানে সুড়সুড়ি খাবেন না। রাস্তায়-স্টেশনে কান খঁচুনিদের দিয়ে কানের ময়লা বার করতে যাবেন না।
  • যাঁদের কানের অসুখ আছে, তারা কখনও ডুব দিয়ে স্নান করবেন না ।
  • প্রথম থেকে চিকিৎসা করালে কানের অসুখ সম্পূর্ণ ভালো হয়ে যায়। কান দিয়ে পুঁজ পড়লে মাইরিনগোপ্ল্যাস্টি, টিউম্যানোপ্ল্যাস্টি, ম্যাসটয়েডেকটমি-সহ নানা ধরনের অপারেশনের প্রয়োজন হয়।
  • শব্দদূষণ এই মুহূর্তে কানের সবথেকে বড় সমস্যা। অতএব সাবধান!